পরিচয়ে আমরা সকলেই মানুষ, আদম সন্তান।
প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় জীবিকা উপার্জন করে। কেউ হালাল বা বৈধ পথে,
কেউ হা’রাম ও অবৈ’ধ পথে। জীবিকার তাগিদে আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বেঁছে
নেয় অবৈ’ধ বা নিকৃ’ষ্ট পেশা।
জীবিকার মধ্যে একটি হলো দে’হব্যবসা বা
পতি’তাবৃত্তি। সমাজের কতিপয় নারী প’তিতাবৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য হয় বলে
আমার ধারণা। তাদের অধিকাংশের এ পথে আসার পেছনে একটি করুণ বাস্তবতা থাকে।
যেই বাস্তবতাটা তাকে কখনো সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়, কখনো তারা চক্ষু
লজ্জায় পরিচিতদের থেকে দূরে সরে যায়।
অধিকাংশ প’তিতা স’র্বহারা হয়ে পরিশেষে কোন একটি নি’ষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় খুঁজে নেয়। জন্মসূত্রে কেউ প’তিতা হয়ে জন্মায় না। এই স্বপ্ন নিয়েও কোন বালিকা বেড়ে ওঠে না। সমাজ ও বাস্তবতা তাকে নি’ষিদ্ধ পল্লীতে নি’ক্ষেপ করে।
অধিকাংশ প’তিতা স’র্বহারা হয়ে পরিশেষে কোন একটি নি’ষিদ্ধ পল্লীতে আশ্রয় খুঁজে নেয়। জন্মসূত্রে কেউ প’তিতা হয়ে জন্মায় না। এই স্বপ্ন নিয়েও কোন বালিকা বেড়ে ওঠে না। সমাজ ও বাস্তবতা তাকে নি’ষিদ্ধ পল্লীতে নি’ক্ষেপ করে।
সেদিন রাত আনুমানিক দুইটার দিকে ঢাকা থেকে
বাসায় ফিরছিলাম। নেমে দেখলাম, বাস স্টপেজের খানিকটা দূরে একটি মেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, এত রাতে মেয়েটির বাইরে কী কাজ? তার
কি কোনো বিপদ হয়েছে? কারণ জানতে তার কাছে গিয়ে দেখলাম- মেয়েটার গায়ে
জীর্ণশীর্ণ পোশাক। আধোয়া কালো একটা চাদর গায়ে মোড়ানো। হাতে সিগারেট।
মুখভর্তি পান। একটু পরপর পিক ফেলছে। আমার বুঝতে কষ্ট হলো না এ-ও সেই
দলভুক্ত। প’তিতা বলে আমরা যাদের গালি দেই। মেয়েটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে
আমি তার কাছে এ পথে আসার গল্পটা জানতে চেয়েছিলাম।
মেয়েটি যা বলল তার সারমর্ম হল- ‘সে একটি
ছেলেকে ভালোবাসতো। ছেলেটিও তাকে ভালোবাসতো। দীর্ঘ তিন বছর শা’রীরিক সম্পর্ক
ছিল তাদের মাঝে। ছেলেদের অর্থবিত্ত বেশ ভালো। সমাজে উঁচু জাতের লোক।
অন্যদিকে মেয়েটির বাবা মারা যায় মেয়েটির চার বছর বয়সে। এরপর থেকে
মানুষের বাসায় কাজ করে মেয়েটিকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়িয়েছিল তার মা।
যায়যায়দিন অবস্থা তাদের সংসারে। তাই মেয়ের মা মনস্থির করলেন, মেয়েকে
বিয়ে দিয়ে দিবেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে মানুষের বাড়িতে আর কাজ করতে পারছেন
না তিনি। এখন মেয়েটিকে ভালো পাত্রস্থ করা ছাড়া উপায় নেই। বিয়ের দিন
তারিখ ঠিক হলো। বিয়েও হয়ে গেল।
কিন্তু ১৬ বছরের মেয়েটি ভালোবাসার আবেগ
কন্ট্রোল করতে পারেনি। স্বামীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে বাড়ি ফিরে আসে।
মেয়েটি ভেবেছিল, ছেলেটির সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ততদিনে ছেলেটি কানাডা
চলে গিয়েছে পড়াশোনার জন্য। মেয়েটির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এদিকে
মায়ের অসুস্থতাও দিন দিন বাড়ছিল। অবস্থা এত দূর গিয়ে পৌঁছল যে, ঘর
ভাড়ার টাকাটাও দিতে পারছিল না তিন মাস ধরে। মায়ের ওষুধের খরচ, ঘর ভাড়া,
বাজারের টাকা কিছুই ছিল না তাদের কাছে। এ-কুল ও-কুল হারা মেয়েটি আস্তে
আস্তে নি’ষিদ্ধ পল্লীর দিকে পা বাড়ায়।’ মেয়েটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে
যখন বাড়ি ফিরছিলাম আমার মন থেকে দেহ-ব্যবসায়ীদের প্রতি ঘৃণা কমে গেল,
সহানুভূতি তৈরি হল। ভাবলাম এরাও মানুষ। এদেরও ধর্ম আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই ধর্ম
আছে।
এমনকি অনেক লেবাসধারীর চেয়েও এদের মনে
আল্লাহর ভয় বেশি, সারাদিন যাই করুক, আজান শুনলে ওড়নাটা মাথায় টেনে নেয়,
কোন আলেম ওলামা হাজি সাহেব দেখলে আড়ালে চলে যায়। হাদীস শরীফে আছে- যে
ব্যক্তি কালিমা বলবে এবং এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে সে জান্নাতে প্রবেশ
করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালামের এ কথা শুনে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন,
যদি সে ব্যভিচার করে, তবুও কি সে জান্নাতে যাবে? বিশ্ব মানবতার মুক্তির
দূত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবাদের বললেন, হ্যাঁ
যদি সে যেনাও করে, তবুও সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (যদি এ বিশ্বাসের ওপর
মৃত্যুবরণ করে) সম্প্রতি রাজবাড়ির দৌলতদিয়ায় একজন যৌ’নকর্মীর ধর্মীয়
রীতি মেনে দাফন ও জানাজার ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছে। দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙ্গে
একজন যৌ’নকর্মীর জানাজার ঘটনা তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে
কতটা কাজ করবে?
আমাদের দেশে দেহ ব্যবসায়ীদের জানাজা
পড়াতে চান না কতিপয় অর্ধশিক্ষিত ইমামরা। পতিতাদের সামাজিক ব’য়কটের
চূড়ান্ত পর্যায় হল এটি। অথচ সেসব অর্ধশিক্ষিত মোল্লারা ইসলামের উদারনীতি
সম্পর্কে বেখবর। এসব কাঠমো’ল্লারা আবার মাহফিল করে। সেখানে সামান্য টাকার
লোভে প্রধান অতিথি বানায় ম’দখোর, চাঁ’দাবাজ, দুর্নী’তিবাজদেরকে। কারণ তারা
পয়সাওয়ালা। কতিপয় এসব ধর্মমোড়ল বিত্তশালী ম’দখোর, চাঁ’দাবাজ,
দুর্নী’তিবাজদের জানাজা পড়ায় খুব গর্বের সঙ্গে। বলে বেড়ায়, অমুক নেতার
জানাজা আমি পড়িয়েছি। তখন কোন ফতোয়া আসেনা এদের মুখ থেকে। প্রথা ভেঙে
দৌলতদিয়ার একজন যৌ’নকর্মীর জানাজা পড়িয়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিলেন যে
মসজিদের ইমাম, তিনি বলছেন, তিনি ভবিষ্যতে আর কখনো কোনো যৌ’নকর্মীর জানাজা
পড়াবেন না। দৌলতদিয়া রেলস্টেশন মসজিদের ইমাম গোলাম মোস্তফা বিবিসিকে
বলছেন, হামিদা বেগমের জানাজা পড়ানোর পর তিনি স্থানীয়ভাবে সমালোচনার মুখে
পড়েছেন।
বিবিসিকে তিনি বলছেন, ‘এইখানে তো সমালোচনা
হচ্ছে। গ্রামের লোক, দোকানদার সবাই আমার সমালোচনা করছে। এতোদিন জানাজা হয়
নাই, আমি কেন হঠাৎ করে জানাজা পড়াইলাম?’ তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতে আর
জানাজা পড়ানোর নিয়ত নাই। বিভিন্ন আলেমের সঙ্গেও কথা বলছি। তারাও নিষেধ
করছে। পল্লীর লোকেরা অন্য কাউকে দিয়ে জানাজা, দা’ফন করাইতে পারে। কিন্তু
আমাকে পাবে না।’ (বিবিসি বাংলা) আমি হাজার বার বলবো, একজন সু’দখোর,
চাঁ’দাবাজ, দুর্নী’তিবাজ, আত’ঙ্কবাদীর চেয়ে একজন দে’হব্যবসায়ী শতগুণে
ভালো। তুলনামূলক সে আল্লাহর কাছে দামি। যদিও তার পাপের শা’স্তি তাকে পেতে
হবে। আর সেই শা’স্তি দিবেন মহান আল্লাহ তাআলা। আমরা বিচারক নই। তাই সকলের
প্রতি উদা’ত্ত আ’হ্বান রেখে বলবো, জানাজা হচ্ছে মৃ’ত ব্যক্তির জন্য দোয়া।
সকল মুসলমানের জন্য জা’নাজা আদায় করা ফরজে কেফায়া। কিছু মানুষ আদায় করে
দিলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কেউ আদায় না করে তবে সকলকেই
আল্লাহর কা’ঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। জবা’বদিহিতার জন্য।
পবিত্র বোখারী শরীফে এসেছে, প্রত্যেক
মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক রয়েছে। সালামের উত্তর দেয়া, কোন
মুসলমান অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া, মুসলমানের জানাজা আদায় করা, কেউ
নিমন্ত্রণ করলে সাড়া দেয়া এবং কেউ হাঁচি দিলে তার উত্তর দেয়া। সুতরাং,
আসুন মানুষের কৃ’তকর্মের ফলাফল নির্ধারণ করার ক্ষম’তা আল্লাহর হাতে ছেড়ে
দেই। বিচারকের চেয়ারটি আল্লাহর জন্য বরাদ্দ থাকুক। প’তিতাদেরকে দূরে ঠেলে
না দিয়ে দ্বীনের পথে ডাকি, তাদের সামনে সুপথ প্রদর্শন করি। মৃ’ত্যুর পর
তাদের শেষ কর্মটি যথাযথভাবে পালন করি। মনে রাখবেন, কেবলমাত্র আলোই পারে
অ’ন্ধকারকে মিটিয়ে দিতে।
লেখক: মুদাররিস, আরবি সাহিত্য ও ইসলামী ফিকাহ, জামিয়া মাহমুদিয়া সাভার ঢাকা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন